শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে, শান্তি আর প্রকৃতির নিসর্গে কিছুটা সময় কাটাতে চাইলে Bisnakandi বিছানাকান্দি হতে পারে আপনার পরবর্তী গন্তব্য। আজ আমরা বলতে যাচ্ছি – বিছানাকান্দি কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন?
বিছানাকান্দির বিশেষ সৌন্দর্য হলো এর অনন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ—এক পাশে পাহাড়, মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ঝর্ণাধারা, আর চারপাশে সবুজের সমারোহ। বর্ষা মৌসুমে যখন পাহাড়ি ঝরনাগুলোর জলরাশি প্রবল বেগে নেমে আসে, তখন বিছানাকান্দি রূপ নেয় এক রূপকথার জগতে।
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটে অবস্থিত বিছানাকান্দি প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গীয় স্থান। পাহাড়, নদী, পাথর আর মেঘের মায়াবী মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা এই পর্যটনকেন্দ্রটি বছরের যেকোনো সময়েই ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ভারতের পাহাড়ি ঢল থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলরাশি, তার সঙ্গে ছোট-বড় পাথরের বিছানো তলদেশ- যেন প্রকৃতি নিজ হাতে এক শিল্পকর্ম এঁকেছে এখানে।
পাহাড়, জল, পাথর আর সবুজ প্রকৃতি যেন একে অপরের সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিলেমিশে গেছে এখানে। বর্ষা মৌসুমে ভারতের পাহাড়ি ঢল থেকে আসা পানি যখন পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যায়, তখন মনে হয় যেন পাহাড় কাঁদছে, আর তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে নদীর বুকে।
স্বচ্ছ পানির তলদেশে অসংখ্য পাথর দেখতে পাওয়া যায়। অনেক পর্যটক নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে সময় কাটান বা পাথরের ওপর হাঁটতে হাঁটতে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করেন। এছাড়া, নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ, দূরে ভারতের পাহাড়, আর পাশে বয়ে চলা ঝর্ণাধারা- এই মায়াময় দৃশ্য মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে।
Bisnakandi বিছানাকান্দি কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বিছানাকান্দি যাত্রা যেমন সহজ, তেমনি রোমাঞ্চকরও। একদিনের জন্য প্রকৃতির কোলে কিছুটা সময় কাটাতে চাইলে এটি হতে পারে আপনার সেরা ভ্রমণ গন্তব্য। স্বচ্ছ নদীর পানি, পাথর আর পাহাড়ের ছায়ায় কাটানো সময় আপনাকে দেবে প্রশান্তি ও মানসিক শান্তি।
ঢাকা থেকে বিছানাকান্দি যেতে হলে প্রথমে আপনাকে সিলেট শহরে যেতে হবে। সিলেট পর্যন্ত যেতে পারবেন বাস, ট্রেন অথবা বিমানে। ঢাকা থেকে সিলেটগামী বেশ কিছু আরামদায়ক বাস প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও রাতে ছাড়ে। বাংলাদেশ রেলওয়ের বেশ কিছু ট্রেন প্রতিদিন ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছাড়ে। যদি সময় কম থাকে, তাহলে বিমানে ঢাকা থেকে সিলেট যেতে পারেন।
ধাপ ১: ঢাকা থেকে সিলেট যাত্রা
ঢাকা থেকে বিছানাকান্দি যেতে হলে প্রথমে আপনাকে সিলেট শহরে যেতে হবে। সিলেট পর্যন্ত যেতে পারবেন বাস, ট্রেন অথবা বিমানে।
বাসে যাত্রা (সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী)
ঢাকা থেকে সিলেটগামী বেশ কিছু আরামদায়ক বাস প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও রাতে ছাড়ে।
বাস সার্ভিস | টিকিট মূল্য | সময় লাগবে |
---|---|---|
শ্যামলী পরিবহন | ৭০০ – ১২০০ টাকা (নন-এসি / এ.সি) | ৫.৫ – ৬.৫ ঘণ্টা |
এনা পরিবহন | ৭০০ – ১২০০ টাকা | ৫ – ৬ ঘণ্টা |
হানিফ পরিবহন | ৭০০ – ১২০০ টাকা | ৫ – ৬ ঘণ্টা |
গ্রীন লাইন | ১২০০ – ১৫০০ টাকা (এ.সি) | ৫ ঘণ্টা |
পরামর্শ: রাতে যাত্রা করলে সকালে সিলেটে পৌঁছে একদিনেই বিছানাকান্দি ঘুরে ফিরে আসা সম্ভব।
ট্রেনে যাত্রা (আরামদায়ক ও নিরাপদ)
বাংলাদেশ রেলওয়ের বেশ কিছু ট্রেন প্রতিদিন ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছাড়ে।
ট্রেনের নাম | ছাড়ার সময় (ঢাকা) | পৌঁছানোর সময় (সিলেট) | টিকিট মূল্য |
---|---|---|---|
পারাবত এক্সপ্রেস | সকাল ৬:৩৫ | দুপুর ১:০০ | ৩৫০ – ১২০০ টাকা |
জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস | দুপুর ১২:০০ | সন্ধ্যা ৬:০০ | ৩৫০ – ১২০০ টাকা |
কালনী এক্সপ্রেস | বিকেল ৩:০০ | রাত ৯:৩০ | ৩৫০ – ১২০০ টাকা |
উপবন এক্সপ্রেস | রাত ৯:৫০ | ভোর ৫:০০ | ৪০০ – ১৩০০ টাকা |
পরামর্শ: ভ্রমণের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য “এসি চেয়ার” বা “স্নিগ্ধা” শ্রেণির টিকিট নিতে পারেন।
বিমানে যাত্রা (সবচেয়ে দ্রুত)
যদি সময় কম থাকে, তাহলে বিমানে ঢাকা থেকে সিলেট যেতে পারেন। বিমান যাত্রার সময়: মাত্র ৩৫–৪৫ মিনিট।
এয়ারলাইন | টিকিট মূল্য | সময়কাল |
---|---|---|
বিমান বাংলাদেশ | ৩৫০০ – ৫০০০ টাকা | ৪০ মিনিট |
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস | ৩৫০০ – ৫০০০ টাকা | ৪০ মিনিট |
নভোএয়ার | ৩৫০০ – ৫০০০ টাকা | ৪০ মিনিট |
নোট: সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শহরে যেতে সিএনজি বা রিকশায় ভাড়া পড়বে প্রায় ১৫০–২০০ টাকা।
ধাপ ২: সিলেট শহর থেকে গোয়াইনঘাট যাত্রা
সিলেট শহর থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলা সদর পর্যন্ত যেতে পারেন সিএনজি, মাইক্রোবাস, অথবা প্রাইভেট কারে।
যাতায়াত মাধ্যম | সময় লাগবে | ভাড়া (একপথ) |
---|---|---|
সিএনজি (শেয়ার) | ১.৫ ঘণ্টা | জনপ্রতি ১৫০–২০০ টাকা |
সিএনজি (রিজার্ভ) | ১.৫ ঘণ্টা | ৮০০–১০০০ টাকা |
মাইক্রোবাস / কার | ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট | ২৫০০ – ৩৫০০ টাকা |
পরামর্শ: বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে গেলে রিজার্ভ গাড়ি নিলে সময় ও আরাম—দুটোই সাশ্রয়ী হবে।
ধাপ ৩: গোয়াইনঘাট থেকে নৌকায় বিছানাকান্দি যাত্রা
গোয়াইনঘাট বাজার থেকে বিছানাকান্দি যেতে হয় নৌকায় করে। এটি ভ্রমণের সবচেয়ে আনন্দদায়ক অংশ। পথে পাহাড়, নদী ও গ্রামের দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়।
নৌকার ধরন | সময় লাগবে | ভাড়া (দুইপথ) | ধারণক্ষমতা |
---|---|---|---|
ছোট নৌকা | ৩০–৪০ মিনিট | ৮০০–১০০০ টাকা | ৪–৫ জন |
মাঝারি নৌকা | ৩০–৪০ মিনিট | ১০০০–১২০০ টাকা | ৬–৮ জন |
বড় নৌকা | ৩০–৪০ মিনিট | ১২০০–১৫০০ টাকা | ১০–১২ জন |
নোট: বর্ষা মৌসুমে পানি বেশি থাকায় নৌকার ভাড়া কিছুটা বেশি হতে পারে।
বিছানাকান্দির দর্শনীয় স্থান
সিলেটের বিছানাকান্দি শুধু একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়, এটি প্রকৃতির জীবন্ত চিত্রকর্ম। এখানকার চারপাশ জুড়ে রয়েছে পাহাড়, ঝর্ণা, নদী আর সবুজে মোড়া প্রকৃতি। তবে শুধু বিছানাকান্দিই নয়, এর আশেপাশে আরও বেশ কিছু মনোমুগ্ধকর স্থান রয়েছে যা একসঙ্গে ঘুরে দেখলে ভ্রমণ হবে আরও উপভোগ্য।
বিছানাকান্দি
বিছানাকান্দির বিশেষত্ব হলো—ভারতের খাসিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনাধারা বাংলাদেশে এসে পিয়াইন নদীতে মিলিত হয়। সেই পানির তলদেশ জুড়ে অসংখ্য পাথর ছড়িয়ে আছে। পর্যটকরা এই স্বচ্ছ জলে হাঁটেন, খেলেন এবং প্রকৃতির মায়ায় হারিয়ে যান। বর্ষায় এর রূপ সবচেয়ে মোহনীয় হয়।
ভ্রমণ টিপস:
- বর্ষায় আসলে প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
- পাথরের ওপর হাঁটার সময় সতর্ক থাকুন, কারণ সেগুলো পিচ্ছিল।
জাফলং
জাফলং বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর একটি। এখানকার নদীর পানি স্বচ্ছ, পাথরে ভরা এবং ওপারে ভারতের পাহাড়ি এলাকা স্পষ্ট দেখা যায়। জাফলংকে বলা হয় “বাংলাদেশের কাশ্মীর”।
দেখার মতো স্থানসমূহ- পিয়াইন নদী, জাফলং চা বাগান, খাসিয়া পল্লি, সাদা পাথরের ঘাট
ভ্রমণ টিপস:
- জাফলং ভ্রমণের সঙ্গে বিছানাকান্দি একদিনে দেখা সম্ভব।
- বর্ষায় গেলে নদীর সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়।
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট
রাতারগুলকে বলা হয় বাংলাদেশের অ্যামাজন। এটি একটি প্রাকৃতিক জলাবন যেখানে বর্ষাকালে গাছগুলো পানির নিচে ডুবে থাকে। নৌকায় ঘুরে ঘুরে গাছের সারি, পানির উপর ভাসমান পাতার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
ভ্রমণ টিপস:
- বর্ষাকালে ভ্রমণের উপযুক্ত সময় (জুলাই–সেপ্টেম্বর)।
- স্থানীয় নৌকা ভাড়া: ৮০০–১২০০ টাকা (দুই ঘণ্টার ট্যুর)।
- লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করুন।
লালাখাল
লালাখাল হলো এক অনন্য সৌন্দর্যের নদী যা মূলত সুরমা নদীর একটি অংশ। পানির রঙ কখনো নীল, কখনো সবুজ—সূর্যের আলো অনুযায়ী রঙ পাল্টায়। নৌকায় ভ্রমণ করলে পাহাড়ের ছায়ায়, পাথরের তলে নীল পানির স্বর্গীয় অনুভূতি পাওয়া যায়।
নৌকা ভাড়া:
- সাধারণ নৌকা: ৮০০ – ১০০০ টাকা
- ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা: ১২০০ – ২০০০ টাকা
সালুটিকর ও ভোলাগঞ্জ
ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের মাঠ ও স্বচ্ছ নদী যেন প্রকৃতির এক খোলা ক্যানভাস। এখানকার প্রধান আকর্ষণ “ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকা”। দূর থেকে দেখা যায় ভারতের পাহাড় থেকে নেমে আসা জলধারা।
ভ্রমণ টিপস:
- সকালবেলা গেলে ভিড় কম থাকে।
- পাথর সংগ্রহ নিষিদ্ধ, তাই সাবধান থাকুন।
মালনীছড়া ও লাভাছড়া চা বাগান
সিলেটের চা বাগানগুলো দেশের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে সুন্দর স্থানগুলোর একটি। মালনীছড়া চা বাগান দেশের সবচেয়ে পুরনো চা বাগান, আর লাভাছড়া বাগান তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।
ভ্রমণ টিপস:
- সকাল বা বিকেল সময় ছবি তোলার জন্য আদর্শ।
- স্থানীয় দোকানে আসল চা চেখে দেখতে ভুলবেন না।
কোথায় থাকবেন?
বিছানাকান্দি ভ্রমণে আসা পর্যটকদের বেশিরভাগই সিলেট শহরে অবস্থান করেন এবং সেখান থেকে সকালে রওনা হয়ে একদিনে ঘুরে ফিরে আসেন। আবার অনেকে শান্ত পরিবেশে রাতযাপন করতে চান — তাদের জন্য সিলেট শহর, জাফলং এবং গোয়াইনঘাট এলাকায় রয়েছে নানা মানের হোটেল, গেস্টহাউস ও রিসোর্ট।
সিলেট শহরে সব ধরণের বাজেট অনুযায়ী হোটেল পাওয়া যায়। যারা একটু আরামদায়ক ও নিরাপদ পরিবেশে থাকতে চান তারা হোটেল নূরজাহান গ্র্যান্ড (দরগাহ গেট), রোজভিউ হোটেল (শাহজালাল উপশহর), হোটেল ফর্চুন গার্ডেন (কাজলশাহ) ও হোটেল হিলটাউন (জিন্দাবাজার) দেখতে পারেন।
যারা প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চান, তারা জাফলং বা গোয়াইনঘাট এলাকায় রাত্রিযাপন করতে পারেন। এখানকার হোটেলগুলোতে থেকে সকালে সহজেই বিছানাকান্দিতে যাওয়া যায়।
এর জন্য জাফলং হিল রিসোর্ট (জাফলং), জাফলং প্যারাডাইস রিসোর্ট (জাফলং বাজার সংলগ্ন), গোয়াইনঘাট ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউজ (গোয়াইনঘাট উপজেলা সদর), পিয়াইন ভিউ রিসোর্ট (গোয়াইনঘাট রোড) সেরা পছন্দ হতে পারে।
সিলেটের সকল হোটেল মোটেল লিষ্ট দেখতে এখানে ক্লিক করুন
ভ্রমণের সেরা সময়
বিছানাকান্দি ট্যুর এর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো জুন থেকে অক্টোবর (বর্ষাকাল)। এই সময় পাহাড়ি ঝরনাগুলোর পানি বেড়ে যায় এবং চারপাশের প্রকৃতি হয় সতেজ ও প্রাণবন্ত। তবে, যারা আরামদায়ক ও ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভ্রমণ করতে চান, তাদের জন্য নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-ও ভালো সময়।
অতিরিক্ত টিপস
- সকালে সিলেট শহর থেকে বের হলে বিকেলের আগেই ঘুরে আসতে পারবেন।
- ভ্রমণের সময় ক্যামেরা, টুপি, সানগ্লাস ও হালকা খাবার সঙ্গে রাখুন।
- পাথরের ওপর হাঁটার সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন, কারণ তা পিচ্ছিল হতে পারে।
- পানি বা খাবারের প্যাকেট নদীতে ফেলা একদম নিষেধ।
বিছানাকান্দি শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি প্রকৃতির এক শিল্পকর্ম। এখানে এসে আপনি বুঝবেন, শান্তি মানে কী, প্রকৃতির নিসর্গ মানে কী। শহরের ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেতে, মনকে নতুন করে সাজিয়ে নিতে, আর জীবনের চাপ কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যেতে বিছানাকান্দি হতে পারে আপনার সেরা গন্তব্য।