নিরীবিলি কোন পরিবেশে হারিয়ে যেতে চান? আপনার জন্য আদর্শ জায়গা হতে পারেন Nijhum Dwip নিঝুম দ্বীপ । এখানে আপনার জন্য বিলাসবহুল কোন আয়োজন না থাকলে প্রকৃতি অপার সৌন্দয্য নিয়ে অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।
নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত হাতিয়া উপজেলার সর্বদক্ষিণে নিঝুমদ্বীপের অবস্থান। ১৯৪০ এর দশকে এই দ্বীপটি বঙ্গোপসাগর হতে জেগে উঠা শুরু করে। মাছ ধরতে গিয়ে হাতিয়ার জেলেরা নিঝুম দ্বীপ আবিস্কার করে।
নিঝুম দ্বীপকে অনেকে ইছামতির দ্বীপ, বাইল্যার চর বা চর ওসমান বলেও ডাকেন। তবে যে নামই হোক না কেন হরিণ এবং মহিষ ছাড়া অন্য কোনো হিংস্র প্রাণী এখানে নেই।
কথিত আছে সর্দার ওসমান নামের এক সাহসী বাথানিয়া ১০০ মহিষ নিয়ে প্রমত্তা মেঘনা পাড়ি দিয়ে প্রথম এই দ্বীপে অসে এবং দিয়ারা জরিপ কর্মচারীদেরকে জরিপ কাজে প্রভূত সহায়তা করে বিধায় তার নামে অনুসারে নিঝুম দ্বীপে মৌজার সরকারি নাম হয় ‘চর ওসমান’।
নিঝুম দ্বীপে রয়েছে প্রায় ৩৫ প্রজাতির পাখি। এছাড়াও শীতের মৌসুমে অজস্র প্রজাতির অতিথির পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় নিঝুম দ্বীপ। নিঝুম দ্বীপে বিশাল এলাকা পলিমাটির চর। জোয়ারের পানিতে ডুবে এবং ভাটা পড়লে শুঁকোয়।
বর্ষা মৌসুমে ইলিশের জন্য নিঝুম দ্বীপ বিখ্যাত। এই সময় ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা নিঝুম দ্বীপে মাছ কিনতে আসে।
এছাড়া শীত কিংবা শীতের পরবর্তী মৌসুমে নিঝুম দ্বীপ চেঁউয়া মাছের জন্য বিখ্যাত। জেলেরা এই মাছ ধরে শুঁটকি তৈরি করেন।
নিঝুম দ্বীপের এক দিকে মেঘনা নদী আর তিন দিকে বঙ্গোপসাগর ঘিরে রেখেছে। এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো মাইলের পর মাইল জুড়ে কেওড়া বন আর সেই বনের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা চিত্রা হরিণ।
দ্বীপের বর্তমান আয়তন প্রায় ৯২ বর্গকিলোমিটার। এর উত্তর অংশে রয়েছে বন্দরটিলা। দ্বীপের ৭০ ভাগ মানুষ মৎস্যজীবী ও ৩০ ভাগ কৃষিজীবী। গভীর সমুদ্র ও নদীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছধরে জীবিকা নির্বাহ করে।
Nijhum Dwip নিঝুম দ্বীপ কি কি দেখবেন?
নিঝুম দ্বীপ যাবেন আর হরিন দেখবেন না? হরিন দেখতে বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে কবিরাজের চরের কাছে চৌধুরীর খাল দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটতে হবে। সেখানে হরিণের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া ট্রলার রিজার্ভ নিলে মাঝিই আপনাদের হরিণ দেখিয়ে আনবে। ১০-১৫ জনের জন্য ট্রলার ভাড়া করতে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা লাগবে। এখানে সন্ধ্যায় কবিরাজের চরে সূর্যাস্থের সাথে হাজার মহিষের পাল আপনার দৃষ্টি কাড়বে।
আর কমলার দ্বীপে কমলার খালে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যায়। স্থানীয়দের কাছ থেকে তাজা ইলিশ কিনতে পারেন।
নামার বাজার থেকে নামা বাজার সি বীচ হেঁটে যেতে ১০ মিনিট সময় লাগে। নামা বাজার সি বীচ থেকে সূর্য উদয় ও সূর্যাস্ত দেখা ছাড়াও বারবিকিউ করতে পারবেন।
দমার চরের দক্ষিণ দিকে নতুন সী বিচটি ভার্জিন আইল্যান্ড হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। এই আইল্যান্ডে নাম না জানা অনেক পাখির দেখা মিলে। এই দ্বীপে যেতে ভাড়া ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা ট্রলার ভাড়া লাগবে।
চোয়াখালিতে নিঝুম রিসোর্ট এর বারান্দা থেকেও মাঝে মাঝে হরিণের দেখা পাওয়া যায়। এছাড়া যদি হাতে সময় থাকে তবে ট্রলার রিজার্ভ নিয়ে ভোলার ঢালচর, চর কুকরি–মুকরিতে একটি দিন কাটিয়ে আসতে পারেন।
শীতকাল অর্থাৎ অক্টোবর থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত সময়। বছরের অন্য সময় মেঘনা নদী ও সাগর বেশ উত্তাল থাকে তাই ওই সময় নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে সতর্ক থাকা উচিত।
নিঝুম দ্বীপ কিভাবে যাবেন?
নিঝুম দ্বীপ যেতে চাইলে আপনাকে প্রথমে ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে করে নোয়াখালী যেতে হবে। নোয়াখালী মাইজদী হতে প্রথমে সোনাপুর বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে।
সেখান থেকে চেয়ারম্যান ঘাট গামী যেকোন লোকাল বাস সার্ভিস/ সিএনজি অটোরিক্সা যোগে চেয়ারম্যান ঘাটে নামতে হবে। এরপর সীট্রাক/লঞ্চ সার্ভিসে নলচিরা ঘাটে নেমে সিএনজি অটোরিক্সা যোগে জাহাজমারা ঘাটে যেতে হবে।
সেখানে গিয়ে নৌকাযোগে জাহাজমারা চ্যানেল পার হয়ে নিঝুম দ্বীপ পৌঁছা যাবে।
ঢাকা থেকে বাসে করে যেভাবে যাবেন
বাসে চড়ে নিঝুম দ্বীপ যেতে চাইলে নোয়াখালীর সোনাপুর নামতে হবে। ঢাকা সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে একুশে এক্সপ্রেস, মুনলাইন এন্টারপ্রাইজ, হিমাচল এক্সপ্রেসের বাসে নোয়াখালীর সোনাপুর যেতে পারবেন।
ধানমন্ডি জিগাতলা কাউন্টার থেকে একুশে পরিবহনের বাস নোয়াখালীর সোনাপুর জন্য রাত ১০ টা ২০ মিনিটে ছাড়ে। এসব বাসের নন-এসি এবং এসি কোচের ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪০০টাকা পর্যন্ত।
নোয়াখালীর সোনাপুর থেকে সিএনজি বা অন্য যানবাহনে করে চেয়ারম্যান ঘাট যেতে হবে, সিএনজি রিজার্ভ করে চেয়ারম্যান ঘাটে আসতে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা ভাড়া লাগবে। একটা সিএনজিতে সর্বোচ্চ ৫ জন বসতে পারবেন।
চেয়ারম্যান ঘাট থেকে হাতিয়া যাওয়ার বিভিন্ন সি-ট্রাক, ট্রলার ও স্পীড বোট পাবেন। চেয়ারম্যান ঘাট থেকে হাতিয়া যাওয়ার সি-ট্রাক, ট্রলার এবং স্পীড বোট ভাড়া জনপ্রতি ৯০, ১২০-১৫০ এবং ৪০০ টাকা।
হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে নেমে মোটর সাইকেল রিজার্ভ করে মোক্তারিয়া ঘাট পৌঁছাতে হবে, মোটর সাইকেল ভাড়া দুই জন ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা লাগবে। মোক্তারিয়া ঘাট থেকে ট্রলারে চড়ে ২২ টাকা ভাড়ায় নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে এসে মোটর সাইকেলে করে নামার বাজার আসতে দুই জনের ভাড়া লাগবে ১০০ টাকা।
নোয়াখালী চেয়ারম্যান ঘাট থেকে প্রতিদিন সকাল ৮ টায় সি-ট্রাক ছাড়ে, আর নলচিরা থেকে নোয়াখালী চেয়ারম্যান ঘাট আসার ফিরতি সী ট্রাক সকাল ১০ টায় ছাড়া।
ঢাকা থেকে ট্রেনে করে যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ট্রেনে করে নিঝুম দ্বীপ যেতে চাইলে নোয়াখালীর মাইজদি ট্রেন থেকে নামতে হবে। ঢাকার কমলাপুর থেকে বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য ৬ দিন বিকাল ৪ টা ২০ মিনিটে উপকুল এক্সপ্রেস নামক আন্তঃনগর ট্রেন নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, মাইজদি পৌঁছাতে প্রায় ৬ ঘন্টা সময় লাগে। ট্রেনের টিকেটের শ্রেনী ভেদে ভাড়া ২৩০ থেকে ৫০৩ টাকা পর্যন্ত।
মাইজদি থেকে চেয়ারম্যান ঘাট আসার সিএনজি রিজার্ভ ভাড়া লাগবে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। আর লোকালে আসতে জনপ্রতি ভাড়া লাগবে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। চেয়ারম্যান ঘাট থেকে উপরোক্ত উপায়ে নিঝুম দ্বীপ যেতে পারবেন।
ঢাকা থেকে লঞ্চে করে যেভাবে যাবেন
ঢাকার সদরঘাট থেকে হাতিয়ায় উদ্দেশ্যে প্রতিদিন বিকাল ৫ টা ৩০ মিনিটে একটি মাত্র লঞ্চ ছেড়ে যায়। লঞ্চটি হাতিয়ার তমুরদ্দী ঘাটে পৌঁছায় পরদিন সকাল ৮ টা থেকে ৯ টার মধ্যে।
হাতিয়ার তমুরদ্দী ঘাটে নেমে মোটর সাইকেল যোগে মোক্তারিয়া ঘাটে আসতে হবে। মোক্তারিয়া ঘাটে আসতে দুইজনের ভাড়া লাগবে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। মোক্তারিয়া ঘাট থেকে নিঝুমদ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে যেতে ট্রলার ভাড়া লাগবে জনপ্রতি ২২ টাকা।
আর বন্দরটিলা ঘাট থেকে মোটর সাইকেলে করে নামার বাজার যেতে দুইজনকে ১০০ টাকা খরচ করতে হবে।
আবার তমুরদ্দী ঘাট থেকেও সরাসরি নিঝুমদ্বীপ নামার বাজার যেতে পারবেন। প্রতিদিন সকাল ১০ টার সময় তমুরদ্দী ঘাট থেকে কিছু ফিশিং ট্রলার সরাসরি নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার যায়, এগুলিতে জনপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা ভাড়ায় যেতে পারবেন।
এছাড়া ট্রলার রিজার্ভ নিয়ে নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার যেতে ট্রলারের সাইজ অনুযায়ী ৩৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা লাগতে পারে।
আবার তমুরদ্দী ঘাট থেকে ঢাকায় ফেরার লঞ্চ দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিটে ছাড়ে। লঞ্চ ভাড়া ডেক – ৩৫০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন – ১২০০ টাকা এবং ডাবল কেবিন – ২২০০ টাকা।
চট্রগাম থেকে যেভাবে যাবেন
চট্টগ্রাম সদরঘাট থেকে শুক্রবার ও রবিবার বাদে সপ্তাহে তিন দিন সকাল ৯ টায় এম.ভি.বার আউলিয়া, এমভি আব্দুল মতিন এবং এম.বি মনিরুল হক স্টীমার হাতিয়া নলচিরা ঘাট পর্যন্ত চলাচল করে। চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে হাতিয়ায় আসতে ভাড়া লাগবে: চেয়ার ক্লাস – ৩৫০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেনী – ১১১০ টাকা এবং প্রথম শ্রেনী – ২২১৫ টাকা।
কোথায় খাবেন
নিঝুম দ্বীপে তেমন ভালো খাবার না পেলেও সামুদ্রিক মাছ, মোটা চালের ভাত, মাংস, রুটি ইত্যাদি পাবেন। নামার বাজারে বেশ কিছু খাবার হোটেল রয়েছে, যেখানে সামুদ্রিক মাছ এবং চিংড়ী ভাজা খেতে বেশ ভালো। নিঝুম দ্বীপে ২০ থেকে ২৫ টাকায় ডাব পাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন?
এখানে থাকার জন্য বেশকিছু রিসোর্ট বা হোটেল আছে। আপনার পছন্দ বা বাজট অনুযায়ী যে কোনটিই বেছে নিতে পারেন। বেশিরভাগ রিসোর্ট বা হোটেলই নামার বাজারে অবস্থিত। এসব হোটেলের মধ্যে রয়েছে-
হোটেলের নাম | ঠিকানা | মোবাইল নাম্বার |
---|---|---|
নিঝুম রিসোর্ট (অবকাশ হোটেল) | নামার বাজার | 01724-145864, 01845-558899, 01738-230655 |
হোটেল শাহিন | নামার বাজার | 01863-15088 |
হোটেল সোহেল | নামার বাজার | |
মসজিদ বোর্ডিং | নামার বাজার | 01866-373937, 01727-958879 |
নিঝুম ড্রিমল্যান্ড রিসোর্ট | বন্দরটিলা | 01847-123573 |
হোটেল দ্বীপ সম্পদ | নামার বাজার | 01720-601026, 01760-008106 |
হোটেল শেরাটন | বন্দরটিলা বাজার | |
জেলা পরিষদ ডাক বাংলো | নোয়াখালি | |
বন বিভাগের ডাকবাংলো | নোয়াখালি |
ভ্রমণ পরামর্শ
- চেয়ারম্যান ঘাট বা নলচিরা থেকে গমনকারী সি-ট্রাকগুলো জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করে যাত্রা করে এবং এখান থেকে প্রতি ২ ঘন্টা পরপর ট্রলার ছাড়ে, আর বিকাল ৫ টার পর ট্রলার চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
- নিঝুম দ্বীপে শুধুমাত্র রবি ও এয়ারটেলের ৩ জি সুবিধা পাওয়া যায়।
- নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই। সোলার এবং জেনারেটরের উপর নির্ভরশীল।
- মোবাইলের এক্সট্রা ব্যাটারী কিংবা পাওয়ার ব্যাংক সাথে রাখুন। তবে প্রয়োজনে টর্চ, মোবাইল কিংবা ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জের জন্য এখানে দুটো দোকান আছে।
One Comment
কোন প্যাকেজ ট্রিপ থাকলে জানাবেন।